Personal Blog | Travel | Tech

জহির রায়হানঃ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গুম হওয়া হতভাগ্য ব্যক্তি ।।

আজ
১৯ শে আগস্ট। বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষণজন্মা প্রতিভা কিংবদন্তী পরিচালক
জহির রায়হানের ৮০ তম জন্মদিন। জহির রায়হান হলেন সেই বিরল হতভাগা লোক যিনি
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাতেন তাঁর চলচ্চিত্রে কিন্তু দেশ যখন সত্যি
সত্যি স্বাধীন হলো তখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গুম হওয়া ব্যক্তি হয়ে
গেলেন জহির রায়হান । স্বাধীন বাংলাদেশের একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী’র সব
অপকর্মের প্রামাণ্য দলিল হাতে পাওয়ায় সেই গোষ্ঠীটি সুকৌশলে জহির রায়হান’কে
হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলেছিল যার
কূল কিনারা সেইসময়ের শাসকগোষ্ঠী তো
করেই নি বরং জহিরকে গুম করার বিষয়টিকে ধামাচাপা ও বৈধতা দিতে ২৮ বছর পর
কোন এক হাবিলদার কে চাক্ষুস সাক্ষী বানিয়ে ১৯৭২ সালের ৩০ শে জানুয়ারির
ঘটনা শুনায় আর সেই স্বার্থান্বেষী মহলের হাতের পুতুল বর্তমানের অন্ধ যুব
সমাজের একটি অংশ সেই মনগড়া কাহিনী প্রচার করে জহিরকে গুম করার অন্যায়টির
বৈধতা দেয় । অথচ একবারও তাঁদের মনে নিচের প্রশ্নগুলো জাগে না  –
১)
৩০ শে জানুয়ারি জহির রায়হান বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা ও মুক্তিযুদ্ধের
সময়কালের একটি রাজনৈতিক নেতাদের গোপন কিছু দুর্লভ তথ্য প্রমাণ প্রেসক্লাবে
উপস্থাপন করার আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন সেদিন তাঁকে অপরিচিত (সরকারি এক
কর্মকর্তা) এক ব্যক্তি ফোন করে মিরপুরে যেতে বলেছিল কেন?
২) সেদিন
ছিল মিরপুর বিহারী পল্লীতে সামরিক অভিযানের দিন যেদিন ‘মিরপুর মুক্তদিবস’
পালন করা হয় । সেই সামরিক অভিযানে একজন বেসামরিক ব্যক্তিকে কেন সংরক্ষিত
এলাকায় প্রবেশ করানো হলো? ১৯৭১ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর শুধু শহিদুল্লাহ কায়সার
একাই নিহত হোননি সেদিন আরও অনেক বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছিলেন , সেইসব
বুদ্ধিজীবী পরিবারের কোন সদস্যকে তো সেই অভিযানে তাঁদের হারিয়ে যাওয়া
প্রিয়জন’কে পাওয়া যেতে পারে বলে তো মিরপুরে ডেকে আনা হয়নি, তবে কেন শুধু
বেছে বেছে জহির রায়হান’কে শহিদুল্লাহ কায়সার’কে পাওয়া যেতে পারে বলে ডেকে
আনা হয়েছিল? জহির তো নিজে থেকেই সেখানে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হোননি,
তাঁকে ফোন করে সেই ঠিকানায় যেতে বলা হয়েছিল , কেন?
৩) জহির যে
তথ্যপ্রমাণ ৩০ শে জানুয়ারি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন সেইগুলো কোথায় কেউ কি
বলতে পারবেন? জহির গুম হওয়ার সাথে সাথে সেই প্রমাণাদি গুলোও কি গুম হয়ে
গেলো? জহির তো সাথে করে সেইসব প্রমাণাদি কিছুই নেননি।
৪) শহিদুল্লাহ
কায়সার’কে পাওয়া যাবে এমন কারনে জহিরকে বেছে বেছে জানুয়ারির ৩০ তারিখেই
কেন মিরপুরে যেতে বলা হলো ? এর আগে বা পরে নয় কেন? …… এসব প্রশ্ন
অন্ধদের মনে জাগবে না  কোনদিন । সত্যি হলো  জহির ২৬ শে জানুয়ারি বিকেলে
ঘোষণা দিয়েছিলেন ৩০ শে জানুয়ারিতে তিনি সব অজানা তথ্য প্রকাশ করবেন আর সেই
৩০ শে জানুয়ারি সকালেই জহিরকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিরপুরে নিয়ে সামরিক
অভিযানের মধ্যে ফেলে হত্যা করে লাশ গুম করা হয় আর দোষ চাপিয়ে দেয়া হয়
বিহারী পল্লিতে থাকা পাকবাহিনীর উপর । একজন বেসামরিক লোককে সামরিক
অভিযানের সংরক্ষিত এলাকায় সেনাবাহিনী প্রবেশ করতে দিলো আর শত্রুপক্ষ সেই
লোকটিকে হত্যা করে ফেললো এমন ‘আষাঢ়ে গল্প’ বিশ্বাস করে যারা তারা আর যাই
হোক স্বাধীন বাংলাদেশের , স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বপক্ষের ব্যক্তি নয় ।আজো
সেই ঘাতক দালালরা এই বাংলার মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।   একদিক না একদিন এই
বাংলার মাটিতে জহির রায়হানের খুনিদের বিচার হবেই হবে ইনশাল্লাহ । 
………………  প্রিয় জহির রায়হানকে নিয়ে আমার পুরনো একটি লিখা দিয়ে
প্রিয় এই মানুষটিকে আজ আবার স্মরণ করলাম শ্রদ্ধায় ।।         
                          

জহির রায়হান
১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ
করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে
বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থানান্তরিত হন। তিনি ১৯৫৮ সালে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ব্যক্তিগত
জীবনে দু’বার বিয়ে করেন: ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি
সুচন্দাকে বিয়ে করেন, দুজনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র
অভিনেত্রী।
জহির রায়হান বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ
করেন। তার সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো
পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া,
যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক
হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ
সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ ঘটে ১৯৫৭ সালে, জাগো
হুয়া সাবেরা ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। তিনি সালাউদ্দীনের
ছবি যে নদী মরুপথেতেও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক
এহতেশাম তাকে এ দেশ তোমার আমার এ কাজ করার আমন্ত্রণ জানান; জহির এ ছবির
নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি রূপালী জগতে পরিচালক হিসেবে
আত্মপ্রকাশ করেন কখনো আসেনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি
পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সঙ্গম নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি)
এবং পরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা মুক্তি দেন। জহির
রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির
ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব
ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র জীবন থেকে
নেওয়াতে। তিনি ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ
শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে
প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কলকাতায় তার নির্মিত
চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়ার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি
দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী
প্রশংসা করেন। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও
তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা
তহবিলে দান করে দেন । (সুত্রঃ উইকিপিডিয়া)
‘জীবন থেকে নেয়া’র পেছনের
অজানা গল্প ঃ ১৯৭০ সালে নির্মিত ও মুক্তিপ্রাপ্ত তৎকালীন পূর্ব
পাকিস্তানের বাংলা চলচ্চিত্রে যে ছবিটি পুরো পাকিস্তান কাঁপিয়ে দিয়েছিল
তার নাম ‘জীবন থেকে নেয়া’ । ছবিটির পরিচালক বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের
অগ্নিপুরুষ জহির রায়হান । ‘জীবন থেকে নেয়া’ শুধুই একটি পারিবারিক ড্রামা
নির্ভর একটি সাধারন ব্যবসাসফল বাণিজ্যিক ছবি নয়। ‘জীবন থেকে নেয়া’ হলো
একটি পরাধীন দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া একটি
ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল
। ‘জীবন থেকে নেয়া’ হলো একটি অত্যাচারী
শাসকের বিরুদ্ধে নিষ্পেষিত জনতার জেগে উঠার প্রতিচ্ছবি। ‘জীবন থেকে নেয়া’
হলো একটি দেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের পটভূমির জলজ্যান্ত চিত্র। তাইতো সেই
শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা বাংলা ছবির একটি
জহির রায়হান এর ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি। আমি ছবিটি সম্পর্কে আজ কোন আলোচনা
করবো না। কারন এই ছবি দেখে বহুজন বহুবার তাঁদের বিস্লেশন ও ভালো লাগা
নিয়ে আলোচনা করেছেন। আজ আমি ছবিটি তৈরি করার পেছনের প্রেক্ষাপট নিয়ে
আলোচনা করবো । কারন সবাইকে জানতে হবে কি কারনে ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি
তৈরি করেছিলেন জহির রায়হান এবং কিভাবে তা হয়ে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের
একটি নতুন অধ্যায়।।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যে কজন তরুন প্রত্যক্ষ
ভাবে অংশগ্রহন করেছিলেন এবং যে ১০ জন ব্যক্তি কারাবরন করেছিলেন জহির
রায়হান সেই ১০ জনের একজন ব্যক্তিছিলেন। সেই সময়ে ঝির রায়হান তার ভাষা
আন্দোলন এর প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘পোস্টার’ নামে একটি গল্প ও ‘আরেক
ফাগুন’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। জহির এর ইচ্ছা ছিল ৫২ এর ভাষা
আন্দোলন নিয়ে একটি ছবির তৈরি করার। সেই ছবিটি তৈরি কয়ার প্রস্তুতিও
নিয়েছিলেন কিন্তু তৎকালীন সরকার ছবিটি তৈরি করতে অনুমতি না দেয়ায় তা আর
তৈরি করতে পারেননি। তবুও জহির দমে যাননি। মনে মনে ঠিকই পরিকল্পনা করেন রুপক
অর্থে হলেও তিনি বাঙ্গালীর আন্দোলন সংগ্রাম আর শোষকের হিংস্ররুপ সিনেমায়
তুলে ধরবেনই। রাজনৈতিক মতাদর্শে জহির ছিলেন একজন প্রগতিশীল ও সাম্রাজ্যবাদ
বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী। বাংলা চলচ্চিত্রের সুচনার পর থেকেই জহির তাঁর
স্বপ্ন, আদর্শ ফুটিয়ে তোলার জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণে জড়িয়ে পড়েন । একে একে
তৈরি করেন কাঁচের দেয়াল, সংগম, বাহানা, আনোয়ারা, টাকা আনা পাই ছবিগুলো।
উল্লেখ্য যে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গিন ছায়াছবি ‘সংগম’ উর্দুতে
নির্মাণ করেছিলেন জহির রায়হান। সেটাই ছিল পূর্ব –পশ্চিম দুই পাকিস্তানেরই
প্রথম রঙ্গিন ছায়াছবি। ১৯৬৯ – ৭০ পর্যন্ত জহির প্রস্তুতি নেন তাঁর বহু
আকাঙ্ক্ষিত ছবিটি নির্মাণ করার। এবার জহির সরাসরি শাসকগোষ্ঠীকে আঘাত না করে
পারিবারিক গল্পের বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি শাসকের অত্যাচার আর
সাধারন জনতার জেগে উঠার চিত্র তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৭০ সালের
মধ্য জানুয়ারিতে জহির রায়হান তাঁর বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত ছবিটি নির্মাণ শুরু
করেন। তখন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু
হয়। এই সময়টাকেই জহির রায়হান বেছে নেন ছবিটির কাজ শুরু করার। প্রথমে
সিদ্ধান্ত নেন যে জহির তাঁর লিখা কাহিনী নিয়ে শুধু ছবিটি প্রযোজনা করবেন আর
পরিচালনা করবেন নুরুল হক বাচ্চু। ছবিটির নাম রাখা হয় ‘তিনজন মেয়ে ও এক
পেয়ালা বিষ’ ,কিন্তু সপ্তাহ খানেক পরেই ছবির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়
‘জীবন থেকে নেয়া’ আর জহির শুধু প্রযোজক নয় পরিচালনাও করবেন। গল্পের বিভিন্ন
চরিত্র ছিল তখনকার সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনার এক একটি রুপক চরিত্র যেখানে
আনোয়ার হোসেন সেই সময়ের জনপ্রিয় কোন রাজনৈতিক নেতার প্রতিনিধিত্বকারী,
রাজ্জাক এর ছাত্রনেতা ফারুক চরিত্রটি প্রতিবাদী ছাত্রনেতার প্রতিনিধি,
মহুরি খান আতাউর রহমান স্বাধীন চেতনার পরিচায়ক, উগ্রচণ্ডী , দজ্জাল রওশন
জামিল একনায়কতন্ত্র স্বৈরশাসক আইয়ুব/ ইয়াহিয়ার রুপক চরিত্র। সেই সময়ের
একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরীতে শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার দৃশটি সরাসরি ২১ এর
প্রভাত ফেরিতেই চিত্রায়ন করা হয় যেখানে সারিবেধে খালি পায়ে শহীদ মিনারে
ফুল দিতে যাওয়া সবই ছিল বাস্তব এর সেই ১৯৭০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি থেকে
নেয়া। ছবির কাহিনীটি সাজানো হয় উগ্রচণ্ডী দজ্জাল বড় বোন
রওশন জামিল
এর নির্যাতনে স্বামী খান আতাউর রহমান নিষ্পেষিত , দুই ভাই শওকত আকবর ও
রাজ্জাক ,দুই ভাইয়ের দুই বধু রোজী ও সুচন্দা এবং বাড়ীর চাকর বাকর ও রোজী
–সুচন্দার বড় ভাই জনপ্রিয় দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ আনোয়ার হোসেন কে নিয়ে ।
পুরো
বাড়ীতে দজ্জাল বড় বোন রওশন জামিল এর একচ্ছত্র আধিপত্য চলতে থাকা অবস্থায়
দুই ভাই বিয়ে করে নববধুদের সংসারে প্রবেশ এবং পরবর্তীতে সংসারের চাবির
ঘোছা নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখার কূটকৌশল চরমে পৌঁছে যা তৎকালীন পূর্ব
পাকিস্তানের ইয়াহিয়া/ আইয়ুব খানের শোষণ ও ক্ষমতা থাকার কূট কৌশলের রুপক
চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন জহির রায়হান। অন্যদিকে আনোয়ার হোসেন ও রাজ্জাক এর
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষ্পেষিত বাঙ্গালীর আন্দোলন সংগ্রাম জেল জুলুম এর
বাস্তব চিত্র ছিল ছবিটিতে। আনোয়ার হোসেন ও রাজ্জাক এর জেলের ভেতর থাকা
অবস্থায় নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি ব্যবহার করে মুলত আন্দোলনে থাকা
বাঙ্গালিদের উৎসাহ যোগান দেয়ার চিত্র। নবজাতক এর নাম ‘মুক্তি’ রুপক অর্থে
স্বাধীন বাংলাদেশ এর জন্ম ও শোষকের হাত থেকে মুক্তির বহিঃপ্রকাশ।
ছাত্রনেতা ইকবালের গ্রেফতার হয়ে কারাগারে প্রবেশ এর সময় উচ্চারিত
রবীন্দ্রনাথ এর ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী’ ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাপিয়ে
পড়ার উৎসাহের তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত যার সবই ছিল জহির রায়হান এর দূরদর্শী
সৃষ্টি। এভাবেই ঝির রায়হান ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটির প্রতিটি ফ্রেমে ফ্রেমে
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। যার চূড়ান্ত
বাস্তবায়ন ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে
শেষ হয়। ছবিতে জহির রায়হান এর ব্যবহৃত রবীন্দ্রনাথ এর কবিতাটি স্বাধীন
বাংলাদেশের ‘স্মৃতিসৌধ’ স্থান পেয়ে বাঙ্গালীর চির প্রেরণার উৎস হয়ে আছে।
‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি যে স্বাধীন বাংলাদেশের ইঙ্গিত বহন করছে তা
বিগ্রেডিয়ার রাও ফরমান আলী , মেজর মালেক ও তাঁদের এদেশীয় দোসররা বুঝতে
পেরেছিলেন। তাই তাঁরা ছবিটিকে সেন্সর ছাড়পত্র না দেয়ার ষড়যন্ত্র করে।
কিন্তু দেশপ্রেমিক সচেতন দর্শকদের মিছিল, স্লোগান ও দাবির মুখে সামরিক
সরকার বাধ্য হয়েছিল এ ছবির ছাড়পত্র দিতে। নির্ধারিত তারিখের এক দিন পর
অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ১১ এপ্রিল। শেষ পর্যন্ত জীবন থেকে নেয়া ‘ ছবিটি মুক্তি
দেন জহির রায়হান । ছবিটি মুক্তি দেয়ার ফলে ষড়যন্ত্রকারীরা হয়েছিল পরাজিত
আর জনতাই হয়েছিল জয়ী। জীবন থেকে নেয়ার মাধ্যমে এভাবেই তৈরি হয়েছিল
বাংলাদেশের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় আর বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছিল এক
অসাধারন কালজয়ী ছবি।।(সুত্রঃ http://www.somewhereinblog.net/blog/Kobiokabbo/29693911)
পিতা
ও পুত্রের এক অসাধারন ভালবাসার প্রতিচ্ছবি ‘টাকা আনা পাই’ঃ তৎকালীন
জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও জহির রায়হান এর স্ত্রী সুচন্দা রায়হান প্রযোজিত,
সুচন্দা চলচ্চিত্র সংস্থার প্রথম নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘টাকা আনা
পাই’ নির্মিত হয় ১৯৬৯ সালে। ছবিটির কাহিনী ও চিত্রনাট্য তৈরি করেন জহির
আহমেদ, গানের কথা লিখেন – গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও আলতাফ মাহমুদ , সঙ্গীত
পরিচালনায় ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। আনিস ফিল্মস কর্পোরেশন এর পরিবেশনায় ছবিটি
পরিচালনা করেন বাবুল চৌধুরী। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন
সংস্থায় গৃহীত ও নির্মিত হয় ছবিটি।
কাহিনী সংক্ষেপ – বাবা হানিফ
বাবুর্চি (শওকত আকবর) ও মা রওশন জামিলের ছেলে শহীদ (রাজ্জাক) । বাব সহায়
সম্বল সমস্ত কিছু বন্ধক রেখে ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন । ওকালতি
পাস করিয়েছেন । বাবা এক সময় তাঁর বন্ধু দিন মোহাম্মদ এর মেয়ের সাথে ছেলের
বিয়ে দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি করেছিলেন । বিষয়টা শহীদ কখনও জানতো না। অন্ধ
হয়েও ছেলের জন্য বৃদ্ধ বয়সে বাবুর্চির কাজ করতেন যাতে ছেলের লিখাপড়ার কোন
অসুবিধা না হয়। ছেলে ওকালতি পাশ করার পর বাবাকে বাবুর্চির কাজ করতে নিষেধ
করেন। বন্ধক রেখে টাকা ধার এনেছিলেন মহাজন আব্দুল্লাহ মিয়া (ইনাম আহমেদ) এর
কাছ থেকে। পাওনাদার ইনাম আহমেদ এর তাগাদায় হানিফ বাবুর্চি অতিষ্ঠ হয়ে
পড়েন।পাওনা শোধ করতে হবে অথবা তাঁর কুৎসিত মেয়ের সঙ্গে ছেলে শহীদের বিয়ে
দিতে হবে । এমন অবস্থায় হানিফ অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাবার চিকিৎসা করানোর মতো
সামর্থ্য নেই শহীদের। একদিকে বাবার চিকিৎসা অন্যদিকে মহাজনের ঋণ শোধের শর্ত
এসব নিয়ে শহীদ চিন্তায় পড়ে যায়। এদিকে শহরের বিত্তশালি খান বাহাদুর এর
একমাত্র আহ্লাদি মেয়ের সঙ্গে ঘোটক আলতাফ শহীদের বিয়ে দেয়ার ফন্দি আঁটেন।
অসুস্থ বাবাকে বাঁচানোর জন্য খান বাহাদুরের মেয়েকে বিয়ে করে ঘর জামাই হওয়ার
শর্তে শহীদ রাজি হয়ে যায়। যার ফলে শহীদ সেই টাকা দিয়ে মহাজনের আব্দুল্লাহ
মিয়ার সব ঋণ শোধ করে অসুস্থ বাবার হাতে জমির দলিল ফিরিয়ে দেয়। শহীদের
বাবাও সুস্থ হয়ে উঠেন । সুস্থ হয়ে উঠার পর বন্ধুর মেয়ে রানুর সঙ্গে বিয়ে
দেয়ার সব ব্যবস্থা করেন কিন্তু বিয়ের দিন শহীদ জানিয়ে দেয় সে আসতে পারবে
না এবং এই রানুকে বিয়ের করতে পারবেনা। ওদিকে শহরের খান বাহাদুর এর মেয়ের
সঙ্গে বিয়ের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর বিয়ের আসরে শহীদের অন্ধ বাবা
তাঁর বন্ধুকে নিয়ে হাজির হয়। বিয়ের আসরেই শুরু হয়ে যায় পিতা ও পুত্রের
অনিবার্য সংঘাত । সেই থেকে শুরু হয় সন্তানের প্রতি এক মমতাময়ী ও অভিমানি
পিতা এবং পিতার মমতা বঞ্চিত এক সন্তানের টানাপোড়ন। যে সন্তান পিতার জন্যই
কঠিন শর্ত মেনে নিয়েছিল যা তাঁর পিতাকে বলতে পারেনি এবং সবসময় লুকিয়ে
পিতাকে সাহায্য করার চেষ্টায় থাকা ব্যকুল এক সন্তানের চিত্র যা একবার
দেখলে মনে গেথে থাকবে সবসময়। বারবার দেখতে ইচ্ছে করবে। এই ছবিতে শহীদ
আলতাফ মাহমুদ এর কণ্ঠে ছোট্ট একটি গান আছে – https://www.youtube.com/watch?v=vMzYzah44MM&x-yt-cl=85114404&x-yt-ts=1422579428

এছাড়া জহির রায়হান এর আরো কিছু ভিডিও দেখুন;

ভিডিও ২

সুনিপুন
অভিনয় – এই ছবিতে যারা অভিনয় করেছিলেন তাদের সকলের অভিনয় এক কথায় অসাধারন
হয়েছিল। একটি ক্লাসিক ছবির যতগুলো গুনাগুন থাকার দরকার তাঁর সবগুলো ছিল
এই ছবিতে। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র শওকত আকবর ও রাজ্জাক তাদের সেরা শিল্প
সম্মত অভিনয় করেছিলেন। এছাড়াও রওশন জামিল, গোলাম মোস্তফা, ইনাম আহমেদ,
ব্ল্যাক আনোয়ার ,আলতাফ, দিন মোহাম্মদ, আনিসুর রহমান সকলেই যার যার চরিত্র
অনুযায়ী অভিনয় করেছিলেন।
ছবির নায়িকা বা খান বাহাদুর এর আহ্লাদি
চরিত্রে ববিতার অভিনয় ছিল মনে রাখার মতো। মা মরা একমাত্র বিত্তশালী পিতার
আদুরে মেয়ে যে পিতার অতি আহ্লাদে এখনও মন ও মানসিকতায় একজন কিশোরী রয়ে
গেছে। যার শারীরিক গঠন ও বয়স বৃদ্ধির সাথে চিন্তা, মানসিকতার কোন কিছুর
পরিবর্তন হয়নি। যার মধ্য স্বামী ও সংসার কি সেই ধারনাটাই আসেনি । একসময় সে
বুঝতে চেষ্টা করে,নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করে। স্বামী রাজ্জাক এর সাথে
মফস্বলে থাকতে শুরু করে। যা একথায় অসাধারন একটি অভিনয় ছিল। অথচ এই ববিতা
ছবির অন্নসকল শিল্পির তুলনায় বয়সে ছোট এবং অভিনয়ে একেবারে নতুন। কিন্তু
ছবিতে ববিতার অভিনয় যেন আলাদা একটা শিল্প হিসেবে যুক্ত হয়েছিল।
পিতা
ও পুত্রের মান অভিমান। ভুল বুঝাবুঝি সবকিছুর আড়ালে যে চিরায়ত ভালোবাসা ও
মমতার শক্ত বন্ধন আছে ছবিতে সেটাই অসাধারন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন জহির
রায়হান তাঁর কাহিনী ও চিত্রনাট্য। পরিচালক বাবুল চৌধুরী শুধু সেই অনুযায়ী
সুনিপুন নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বিদেশি ছবির প্রতিবেদন বা রিভিউ না দিয়ে
আমাদের দেশের মাঝেই বাস্তব জীবনের সাথে মিলথাকা শিল্পসম্মত অসাধারন ছবি আছে
সেটা বলার জন্যই আমার এই অতি নগণ্য পোস্ট। আশাকরি যা ছবিটি দেখেন নি
তাঁরা ছবিটি দেখবেন। যারা আগে দেখেছিলেন তাঁরা আবার দেখবেন কারন এটা যে
আমাদের বাংলার গর্ব করার মতো একটি ছবি। বাংলার মানুষের জীবনের কথা বলার
একটি ছবি।
এবার সংক্ষেপে জহির রায়হান’কে গুম করার কারণটা একটু বলছি।
বর্তমান সময়টা খুবই খারাপ যাচ্ছে তাই জহির রায়হানের গুম হওয়ার পেছনের সকল
তথ্য উপাত্ত আপনাদের কাছে আজ তুলে দিতে পারছি না বলে দুঃখিত । কারণ আজ
এসব বলতে গেলে জহিরের খুনিরা আমাকেও গুম করে ফেলে দিতে পারে । তবে কথা
দিলাম একদিন সব জানাবো ইনশাল্লাহ ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭১ সালের
১৭ ডিসেম্বর জহির রায়হান ঢাকায় ফিরে আসেন। ফিরে এসেই শুনলেন তার অগ্রজ
শহীদুল্লাহ কায়সার ১৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। আদর্শস্থানীয় বড় ভাইকে হারিয়ে
তিনি পাগলের মত তাকে খুঁজতে থাকেন। তাঁর উদ্যোগে বেসরকারি বুদ্ধিজীবী
হত্যা তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডসহ অন্যান্য ঘটনার
প্রচুর প্রমাণাদি তিনি সংগ্রহ করেন এবং সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে,
তার সংগৃহীত প্রমাণাদি প্রকাশ করলেই অনেকের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাবে।
স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মাটিতে আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয়
ব্যক্তিবর্গের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকান্ড, বিভিন্ন হোটেলে বিলাসবহুল ও
আমোদ-ফুর্তিময় জীবনযাপন, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষ আওয়ামী আদর্শে বিশ্বাসহীন
বাঙালিদের নির্মূল করার ষড়যন্ত্র প্রভৃতির প্রামাণ্য দলিল জহির রায়হান
কলকাতা থাকাকালে সংগ্রহ করেছিলেন। বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের নিখোঁজ ও
বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের ঘটনাবলী তাকে বিচলিত করে। এসব ঘটনা তাঁর
পূর্বেকার রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়।
শেখ মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ১৫ দিন পর ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি
ঢাকা প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে কৃতী চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান
ঘোষণা দেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পেছনে নীলনকশা উদ্ঘাটনসহ
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক গোপন ঘটনার নথিপত্র, প্রামাণ্য দলিল তার কাছে
আছে, যা প্রকাশ করলে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রীসভায় ঠাঁই নেয়া অনেক
নেতার কুকীর্তি ফাঁস হয়ে পড়বে। আগামী ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় এই প্রেসক্লাবে
ফিল্ম শো প্রমাণ করে দেবে কার কি চরিত্র ছিল।
১৯৭২ সালের ২৫
জানুয়ারি সাংবাদিক সম্মেলনের কয়েকদিন পর ৩০ জানুয়ারি রোববার সকালে এক রফিক
নামের অজ্ঞাত টেলিফোন আসে জহির রায়হানের কায়েতটুলির বাসায়।রফিক ছিলেন
জহিরের পূর্ব পরিচিত যিনি ইউসিসে চাকরি করতেন । প্রথমে ফোন ধরেছিলেন জহির
রায়হানের ছোট বোন ডাক্তার সুরাইয়া যার কাছে জহিরকে খোঁজা হচ্ছিল । সুরাইয়া
জহির রায়হানকে ডেকে ফোন ধরিয়ে দেয় । টেলিফোনে জহিরকে বলা হয়েছিল, আপনার
বড়দা মিরপুর বারো নম্বরে বন্দী আছেন। যদি বড়দাকে বাঁচাতে চান তাহলে
এক্ষুণি মিরপুর চলে যান। একমাত্র আপনি গেলেই তাকে বাঁচাতে পারবেন। টেলিফোন
পেয়ে জহির রায়হান দুটো গাড়ী নিয়ে মিরপুরে রওনা দেন। তাঁর সাথে ছিলেন ছোট
ভাই মরহুম জাকারিয়া হাবিব, চাচাত ভাই শাহরিয়ার কবির, বাবুল (সুচন্দার ভাই),
আব্দুল হক (পান্না কায়সারের ভাই), নিজাম ও পারভেজ।মিরপুর ২ নং সেকশনে
পৌছার পর সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (ইস্ট
বেঙ্গল রেজিমেন্ট) এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে জহির
রায়হানের টয়োটা গাড়ি (ঢাকা-ক-৯৭৭১)সহ থাকতে বলে অন্যদের ফেরত পাঠিয়ে দেন।
শাহরিয়ার কবির অন্যদের সাথে করে বাড়ী ফিরে আসেন । এভাবেই জহির চিরতরে
হারিয়ে যায়। অথচ সেদিন বিকেলেই প্রেসক্লাবে তাঁর কাছে থাকা অনেক দুর্লভ
তথ্য প্রমান ফাঁস করার কথাছিল যা ফাঁস হলে অনেকের মুখোশ উম্মোচিত হয়ে যেতো
যা আর কোনদিন করা হলো না ।
জহির রায়হান এর প্রথম স্ত্রী প্রয়াত
অভিনেত্রী সুমিতা দেবী এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন ”জহির রায়হান নিখোঁজ এই
নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বেশ লেখালেখিও হলো। একদিন বড়দি অর্থাৎ জহিরের বড় বোন
নাসিমা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব বললেন, জহিরের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে এ রকম
চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে। পরে নাসিমা আর কিছু বলেনি। টেলিফোন
করেছিল যে রফিক, তাকে নিয়ে যখন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলো। তখন তাকে
নাগরিকত্ব দিয়ে পুরো পরিবারসহ আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। এই ঘটনা জহিরের
নিখোঁজ হওয়ার সম্পর্কে রফিকের ভূমিকাকে আরো সন্দেহযুক্ত করে তোলে আমার
কাছে।” (সুত্রঃ দৈনিক আজকের কাগজ ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩)
দৈনিক আজকের কাগজ
৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সংখ্যা ‘জহির রায়হানের হত্যাকারী রফিক এখন কোথায়’ শীর্ষক
প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে ‘রাহুর কবলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি’ গ্রন্থে
সরকার সাহাবুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘আজকের কাগজের ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সংখ্যায়
জহির রায়হানের হত্যাকারী রফিক এখন কোথায়’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত
হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জহির রায়হান নিখোঁজ এই নিয়ে লেখালেখি হলে একদিন
বড়দি অর্থাৎ জহির রায়হানের বড় বোন নাফিসা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব
বললেন, জহিরের নিখোঁজ নিয়ে এ রকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে।
কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, জহির রায়হানের মতো একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র
নির্মাতা স্বাধীনতার পর নিখোঁজ হয়েছে এটা নিয়ে চিৎকার হওয়াটাই স্বাভাবিক।
জহির রায়হান তার বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে মিরপুরে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ
হন। সম্ভব তাকে হত্যা করা হয়েছিল। সুতরাং তার হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে
তার আত্মীয়-স্বজন সোচ্চার হতেই পারেন। কিন্তু শেখ মুজিব কেন জহির
রায়হানের বড় বোনকে ডেকে নিয়ে নিখোঁজ করে ফেলার হুমকি দিলেন। কি রহস্য ছিল
এর পেছনে? তাহলে কি বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে শেখ মুজিব এমন কিছু
জানতেন, যা প্রকাশ পেলে তার নিজের কিংবা আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতির কারণ
হতো? আর কেনইবা তড়িঘড়ি করে জহির রায়হানের তথাকথিত হত্যাকারী রফিককে
সপরিবারে আমেরিকা পাঠিয়ে দেয়া হলো? রফিক কে ছিলেন/ কি তার রাজনৈতিক পরিচয়?
(সূত্র : সরকার সাহাবুদ্দিন আহমদ, রাহুর কবলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঢাকা,
পৃষ্ঠা-১০৮)
৯ আগস্ট ১৯৯৯ দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়
জহির রায়হানের মেজো সন্তান অনল রায়হানের অভিযোগ। তিনি অভিযোগ করেন, ‘জহির
রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার এক ভুয়া তদন্ত কমিটি গঠন
করেছিলেন। এই কমিটি কোনো কাজ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের প্যানপ্যানানি করে
আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এলো …মুজিব হত্যার বিচার হচ্ছে। এই
হত্যাকান্ড ঘটেছে ১৯৭৫ সালে। এর আগে জহির রায়হানসহ অনেক বুদ্ধিজীবীকে
হত্যা করা হয়েছে। কই তাদের তো বিচার হলো না।’
ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে
শাহরিয়ার কবির???ঃ ১৯৯২ সালের ১ মে তারিখে সাপ্তাহিক বিচিত্রায়
বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা
হয়েছিল।সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন শাহরিয়ার কবির।সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে
সত্যজিত রায় শাহরিয়ার কবিরকে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন,
-জহিরের ব্যাপারটা কিছু জেনেছো?
-তাকে
সরিয়ে ফেলার পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে
তদন্ত করে যা বুঝতে পেরেছি তাতে বলা যায়, ৩০ জানুয়ারি দুর্ঘটনায় তিনি
হয়তো মারা যাননি। তারপরও দীর্ঘদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল বলে অনেকে মনে
করেন।
-স্ট্রেঞ্জ! জহিরকে বাঁচিয়ে রাখার পেছনে কারণ কি?
-সেটাই
ষড়যন্ত্রের মূল সূত্র বলে ধরছি। মিরপুরে দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলে গভীর
ষড়যন্ত্র মনে করার কোনো কারণ ছিল না। আমি যতদূর জানি, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার
তদন্ত করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন যা অনেক
রথী-মহারথীদের জন্যই বিপজ্জনক ছিল, সে জন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন
ছিল।” ………শাহরিয়ার কবির জানতেন ,সবই জানতেন কিন্তু কাউকে কিছু
বলেননি , আপনারা বুঝে নিন ।।

মূল লেখকঃ Fazlay Alahi  

[ লেখার সোর্স এখানে ]

Spread the love

Leave a Comment