Personal Blog | Travel | Tech

ফ্লপিডিস্কের রিপ্লেসমেন্ট


চারকোনা, পাতলা একটি ডিভাইস, খুব স্বল্পই স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখতে পারে। একনামে সবাই চেনে, ডিভাইসটি আর কিছুই নয়, ফ্লপি ডিস্ক।
যেগুলো সাড়ে তিন ইঞ্চি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আট ইঞ্চি পর্যন্ত বড় ছিল। সেইসময়ে সবার কাছে এই ছোট্ট ডিভাইসটিই ছিল অনেক মূল্যবান। অতি সাবধানে ও যত্ন সহকারে ব্যবহার করা হতো। তবে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে গেছে প্রযুক্তিও। দিনকে দিন আপডেটের ধাক্কায় হারিয়ে গেছে আমাদের এই ছোট্ট ডিভাইসটি। সেই জায়গাটি নিয়ে নিয়েছে বর্তমান যুগের পেনড্রাইভ। যেগুলো একদিক দিয়ে যেমন ফ্লপি ডিস্কের থেকে ছোট, অপরদিকে এর স্মৃতি ধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি। আর এই বিশাল সাফল্যের পিছনে যে ব্যক্তিটির অবদান রয়েছে তিনি হলেন, ‘পুয়া কেইন সেংস’। পেনড্রাইভের এই তরুণ আবিষ্কারককে নিয়ে লিখেছেন প্রাঞ্জল সেলিম

মালয়েশিয়ায় জন্ম কিন্তু তার পড়াশোনার পর্বটি সেরেছেন তাইওয়ানে। তাইওয়ানের চিয়ো টুয়াং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি নেন তিনি। পুয়া কেইন সেংস যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন, সেই সময়ে থেকেই তিনি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে গেছেন একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। ১৯৯৯ সালে পড়াশোনা শেষ করে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন। সেখানে সমবয়সী কয়েকজন প্রকৌশলীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো। সেই সহকর্মীদের সাথে নিয়ে তিনি ‘ফিজন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। ফিজন ইলেক্ট্রনিকস করপোরেশন ২০০০ সালে সম্পূর্ণরূপে কাজ শুরু করে। একঝাঁক তরুণের প্রচেষ্টায় মাত্র ছয় মাসের মধ্যে তাদের প্রথম আবিষ্কার তারা বিশ্বের বাজারে আনেন। আর সেই আবিষ্কারটি হলো ইউএসবি স্টোরেজ ডিভাইস, একবাক্যে ‘পেনড্রাইভ’। ইউএসবি ফ্লাশ ড্রাইভ ফ্লাশ ডাটা স্টোরেজ ডিভাইস এবং ইউএসবি (ইউনিভারসাল সিরিয়াল বাস) ইন্টারফেস এর সমন্বয়ে গঠিত । ইউএসবি ফ্লাশ ড্রাইভ সাধারণত সিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্নকরণযোগ্য এবং এতে পুনরায় ডাটা লিখা যায়। এটি বাহ্যিকভাবে ফ্লপি ড্রাইভ থেকে অনেক ছোট । অধিকাংশ ইউএসবি ফ্লাশ ড্রাইভ ওজনে ৩০ গ্রাম এর চেয়ে কম। আকার ও খরচ ঠিক রেখে ২০১০ সালে ২৫৬ গিগাবাইট ধারণক্ষমতা পর্যন্ত ইউএসবি ফ্লাশ ড্রাইভ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। কিছু ইউএসবি ফ্লাশ ড্রাইভ ১০ বছর পর্যন্ত ডাটা ধরে রাখতে পারে।

ফ্লপি ড্রাইভ যে কারণে ব্যবহার করা হতো ইউএসবি ফ্লাশ ড্রাইভ ও একই কারণে ব্যবহার করা হয়। ইউএসবি ফ্লাশ ড্রাইভ আকারে ছোট, অনেক দ্রুত, হাজার গুণ বেশি ধারণক্ষমতা এবং চলমান পার্টস না থাকায় অনেক বেশি টেকসই এবং নির্ভরযোগ্য। আনুমানিক ২০০৫ সাল পর্যন্ত সকল ডেস্কটপ এবং ল্যাপটপ-এর সাথে ফ্লপি ডিস্ক ড্রাইভ দেয়া হতো, কিন্ত ইদানীং ইউএসবি পোর্ট-এর আনুকূল্যে ডেস্কটপ এবং ল্যাপটপ-এর সাথে ফ্লপি ডিস্ক ড্রাইভ দেয়া হয় না। ফ্লাশ ড্রাইভ-এ ইউএসবি মাস স্টোরেজ স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার করা হয় যা আধুনিক অপারেটিং সিস্টেম যেমন উইন্ডোজ, ম্যাক ওএসএক্স, লিনাক্স ইত্যাদি স্বভাবতই চিনতে পারে। ইউএসবি ২.০ ইন্টারফেস সম্পন্ন ইউএসবি ড্রাইভগুলো অনেক বেশি ডাটা অপটিক্যাল ড্রাইভ-এর চেয়ে অনেক দ্রুত স্থানান্তর করতে পারে এবং বেশ কিছু নতুন সিস্টেম যেমন এক্সবক্স ৩৬০, প্লেস্টেশন ৩, ডিভিডি প্লেয়ার ও কিছু স্মার্টফোন ইউএসবি ২.০ সমর্থন করে এবং ডাটা পরতে পারে। ফ্লাশ ড্রাইভ-এ কোন কিছু এ যান্ত্রিকভাবে চলাচল করে না। তারপরেও ড্রাইভ নামটি রয়ে গেছে, এর কারণ হলো কম্পিউটার যান্ত্রিক ডিস্ক-এর ডাটা পড়ার জন্য যে সকল সিস্টেম ইন্সট্রাকশন ব্যবহার করত, ফ্লাশ ড্রাইভ-এর ডাটা পড়ার জন্য ও একই সিস্টেম ইন্সট্রাকশন ব্যবহার করে যেন ইউএসবি স্টোরেজটি কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম ও ব্যবহারকারীর ইন্টারফেস-এর কাছে অন্য একটা ড্রাইভ হিসেবে উপস্থাপিত হয়। যান্ত্রিক হিসেবে ফ্লাশ ড্রাইভ অনেক ক্ষমতাসম্পন্ন।

ফ্লাশ ড্রাইভে একটি ছোট ছাপানো সার্কিট বোর্ড থাকে যাতে এর অন্যান্য যন্ত্রাংশ এবং ইউএসবি কানেক্টর থাকে। সার্কিট বোর্ডটি ইলেকট্রিসিটি অপরিবাহি প্লাস্টিক বা ধাতু বা রাবার কেস দিয়ে আবৃত যা পকেটে বহনযোগ্য । ইউএসবি কানেক্টর সাধারণত একটি অপসারণযোগ্য ক্যাপ দিয়ে ঢাকা থাকে বা কেস-এর ভিতরে ঢুকিয়ে রাখা যায়। অধিকাংশ ফ্লাশ ড্রাইভ স্ট্যান্ডার্ড টাইপ-এ ইউএসবি কানেক্টর ব্যবহার করে। অধিকাংশ ফ্লাশ ড্রাইভ ইউএসবি কানেকশন থেকে বিদ্যুত্ সরবরাহ নেয়। এর জন্য কোন ব্যাটারি দরকার হয় না। কিছু ডিভাইস যাতে ডিজিটাল অডিও প্লেয়ার-এর সাথে ফ্লাশ ড্রাইভ স্টোরেজ থাকে, এই ধরনের ডিভাইস-এর জন্য ব্যাটারি দরকার হয়।

এই পেনড্রাইভে করে হাজার ছবি কিংবা ওয়ার্ড ফাইল পুরে পকেটে নিয়েই দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা। প্রয়োজন হলে যেকোনো কম্পিউটারে বা ল্যাপটপে যুক্ত করে এতে থাকা তথ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারও করে নিচ্ছি। এতে ইউএসবি সংযোগ থাকাতেই এত সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। তবে এটি পেনড্রাইভ নামেই বেশি পরিচিত। ডিভাইসটি প্রথম তৈরি করেন পুয়া কেইন সেংস। পুয়া কেইন সেংস তাদের কোম্পানি, ‘ফিজন’ সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা যখন প্রতিষ্ঠানটি শুরু করি, তখন আত্মবিশ্বাস ছিল, সফল হবো। আমরা শুরু থেকেই ইউএসবি টেকনোলজি নিয়ে কাজ করছিলাম।’ এই কোম্পানির চার সদস্যের মধ্যে দুজন মালয়েশিয়ান এবং বাকি তিনজন তাইওয়ানের প্রকৌশলী। তারা ইউএসবি চিপ নিয়ে কাজ করার শুরু করেন, তখনই তার ধারণা হয়, যদি তারা এই প্রজেক্টে সফল হতে পারেন তবে বিশ্ব বাজারে তা অবশ্যই জনপ্রিয়তা পাবে। কিন্তু সেই সময়ে তার কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায়নি। তবে তারা কেউ আশাও করেনি, তাদের এই প্রজেক্টটি শুধু সফলই না ব্যাপক সাড়া ফেলে দিবে কম্পিউটার জগতে। মজার ব্যাপার হলো তারা যখন এই প্রজেক্টটি করছিলেন, তখন তাদের এই প্রোডাক্টটি কিভাবে বাজারজাত করবেন সেই ধারণাটি তাদের ছিল না।

পেনড্রাইভ বাজারে আসে ২০০১ সালের জুন মাসে। বিস্ময়করভাবে আগস্টের মধ্যেই সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে তাদের এই উদ্ভাবন। সেপ্টেম্বরেই তারা লাভের মুখ দেখেন। ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা সম্পর্কে পুয়া কেইন সেংস বলেন, তিনি মালয়েশিয়াতে ফিজন ইলেক্ট্রনিক্সের শাখা খুলতে চান এবং দেশের উন্নয়নে কাজ করে যেতে চান। ভবিষ্যত্ প্রকৌশলীদের নিয়েও কাজ করার ইচ্ছা আছে তার। তিনি নতুনদের সঙ্গে কাজ করে তাদের ধারণার সঙ্গে পরিচিত হতে চান সব সময়। তিনি মনে করেন, নতুনদের কাছে শেখার অনেক কিছু আছে।

পুয়ার প্রতি তাইওয়ান কৃতজ্ঞ। কারণ, তিনি তাইওয়ানে বসে পেনড্রাইভ আবিষ্কার করেছেন। তবে শুধু তাইওয়ান না, আজ পুরো বিশ্ব তার এই আবিষ্কারের জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ। এই পেনড্রাইভ বাজারজাত করে তাইওয়ান ৩১ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করে।
লেখক: ইত্তেফাক ডেস্ক | শুক্র, ১৭ জুন ২০১১, ৩ আষাঢ় ১৪১৮

Spread the love

1 thought on “ফ্লপিডিস্কের রিপ্লেসমেন্ট”

Leave a Comment