সেদিন অফিশিয়াল ট্যুরে বগুড়া গিয়েছিলাম, মেন্স ওয়ার্ল্ড এর বগুড়া শাখার গ্র্যান্ড ওপেনিং এ বগুড়া পুলিশ সুপার মহোদয় কে দাওয়াত দিতে। এর সাথে সাথে সেখানে গ্র্যান্ড ওপেনিং এর সময়ে একজন ইউটিউবার এর উপস্থিতিতে বিপুল মানুষের ভীড়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য ডিএসবি কর্তৃক অনুমোদন এর দায়িত্ব ছিলো মূখ্য।
কাজ শেষে অনুমোদন এর চিঠি (পুলিশ সুপার ও ডিএসবি’র সাইন ও সীল মোহর সহ) আর এশিয়া থেকে দই (২টা) নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হই চারটায় এসআর ট্রাভেলস এ।
রাত শোয়া ১০ টায় মাজার রোড কাউন্টারে নেমেই টয়লেটে যাই। বের হয়ে দই এর বক্স নিয়ে কাউন্টারের মুখেই অনেক সিএনজির ডাকাডাকিতে একজনের (মুখে মাস্ক ছিলো) সাথে চিটাগাং রোড এর ভাড়া কনফার্ম হয়। কিন্তু সেটা ছিলো অনেক কমে। মোটামুটি খুশিই হয়েছিলাম!
সিএনজি চলতে শুরু করলে, বাসায় কল করে জানাই রওনা হয়েছি। আমি দই এর বক্স টা আমার সীটের ডান পাশে রাখে মাঝে বসি।
টেকনিক্যাল মোড়ে ও শ্যামলী পর্যন্ত তার চালানোর গতি ছিলো তুলনামূলক কম ও সর্ব বাম লেনে। এর মাঝে সে অনেকবার হর্ন বাজায়। যাতে আমার মনে কিছুটা সন্দেহের সৃষ্টি করে।
আমি তখন মোবাইলে ব্যস্ত, কানে বাডস ঢুকানো। বেশ কিছু রিপোর্ট ও ভয়েস কমিউনিকেশনে ব্যস্ত ছিলাম।
শ্যামলী পার হলে আমি সিএনজি ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করি, মামা কাল কি অবরোধ আছে? সিএনজি ড্রাইভার মাথা নাড়িয়ে “হ্যা” উত্তর দেয়।
আসাদ গেটে এলে সিগনাল না থাকায় পার হয়েই স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়! আমি এবার সাবধানী হয়ে দুই মোবাইল দুই পকেটে রেখে পাজামার চেইন লাগিয়ে বাডস খুলে পকেটে রেখে এলার্ট হয়ে বসে থাকি! আমি সত্যিই কিছু একটা হতে যাচ্ছে চিন্তা করেই নড়েচড়ে বসি আর তার কর্মকাণ্ড দেখি!
সিএনজি ড্রাইভার এর সীট খুলে নাড়াচাড়া দিলো, পেছনে যেয়ে নাড়াচাড়া দিলো। এরপরে এসে আমার ডান পাশের গেট খুলে “দই এর বক্স” টা পেছনে রেখে সেখানেও নাড়াচাড়া দিলো টেকনিক্যাল কোন কাজে। তার সীটে যাওয়ার আগে সে বলে, “মাঝে বসেন”! বলেই, সিএনজি স্টার্ট দিলো।
আমি এই কথা শুনেই নিজেকে সামলানোর সময় পাইনি আর!
তাৎক্ষণিক মাস্ক পরিহিত তিনজন এসে একে একে আমার বাম পাশে, কোলে আর ডান পাশে বসে গেলো। এর সিএনজি চলতে শুরু করলো…
আমি স্তব্ধ, নির্বাক আর শক্ত হয়ে গেলাম।
জীবনে প্রথমবারের মতো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েই গেলাম।
হোক সেটা ছিনতাই, কিডন্যাপ বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা গুম!!!
তাৎক্ষণিক মহান আল্লাহকে স্মরণ করা শুরু করলাম। একমাত্র তার থেকেই সাহায্য পাওয়ার জন্য জীবনে যত রকম বিপদ-আপদে পড়ার দোয়া শিখেছিলাম, মোটামুটি সবটাই পড়া আরম্ভ করলাম।
বামেরজন আমার বাম হাত ও পিঠ চেপে ধরেছে। সামনেরজন কোলে বসে পা চেপে সিএনজির গ্রিলে ধরে বসে আছে। ডানেরজন ডান হাত চেপে ধরে তার বাম হাতে ও তার ডান হাতে থাকা অস্ত্রের নল আমার ঠিক কিডনি বরাবর ঠেকিয়ে রেখেছে।
দুই পাশের দুইজন সমান তালে বলে যাচ্ছে,
– চালাকি করার চেস্টা করিসনা, চিল্লা চিল্লা করিসনা। নাইলে গুলি কইরা দিমু”! “তোর কোন ক্ষতি হইবোনা, তোর কোন জিনিস খোয়াও যাইবোনা। শুধু যা বলি তাই শোন আর উত্তর দে!
-কি করস?
-ফ্যাশন হাউজে জব করি
-অফিস কই তোর?
– নয়া পল্টন
– পার্টি অফিসের কোন দিকে?
– পূর্ব দিকে
– তাইলে পার্টি অফিসের কাজ কাম ভালোই করস!
“আমি চুপচাপ, স্তব্ধ হয়ে বসে আছি”
– কই গেছিলি?
– বগুড়া
– কেন গেছিলি?
– অফিসের কাজে
– মিছা কইসনা, তাইলেই শেষ তুই! আমরা তো শেষ হইছিই। তোরে সহ জালাইয়া দিমু এই সিএনজি!
– ভাই, আমি সত্য বলছি কিনা আমার আইডি কার্ড (বাম পকেটে) আর অফিশিয়াল ডকুমেন্টস (ডান পকেটে) আছে। দেখেন আপনারাই।
ততক্ষণে বাম ও সামনেরজন, আমার ঘড়ি (Garmin Forerunner® 945) খুলে নেয়। পাঞ্জাবির পকেট থেকে অফিশিয়াল আইডি কার্ড, ডকুমেন্টস, বাডস, পানির বোতল বের করে নেয়।
সামনের জন ঘড়ির মেন্যু দেখে বলে,
– ওর ঘড়িতে তো ট্র্যাকিং আছে। ঐ, ঘড়ি বন্ধ কর!
আমি করে দিলাম!
পাজামার বাম পকেট থেকে মোবাইল [Samsung A51] নিয়ে বলে, এটার লক খুল।
আমি কথা শুনিনা। এবার বলে বন্ধ কর!
আমি বন্ধ করে দিলাম ডিরেক্ট ফিঙ্গারপ্রিন্ট এর দিয়ে।
পাজামার ডান পকেট থেকে মোবাইল [Samsung S23 Ultra] নিয়ে বলে, এতো মোবাইল কেন রে? এটাও বন্ধ কর!
আমি ডিরেক্ট বন্ধ(ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে) করতে গেলে আমার ছোট ছেলের ছবি দেখা যায়। তখন ডানেরজন জিজ্ঞেস করে,
– ছেলেমেয়ে কয়জন?
– তিনজন
– মাশাআল্লাহ (বামের জন)
এতোক্ষণে অনেকবার অনেকভাবে মহান আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছি আর শুরু থেকেই চিন্তা করছি, চিৎকার দিবো কিনা! আবার নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে দোয়ায় মনোনিবেশ করি।
এই সময় তাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলে তারা রেগে যায়। তারা মানিব্যাগ এর সব কার্ড হাতায় আর টাকা খুজে! আইডি কার্ড ও ডকুমেন্টস (পুলিশ সুপারের সীল ও সাইন সহ) দেখে নেয়!
সিএনজির র্যুট ততক্ষণে ছিলো এমন…
আসাদগেট, মানিকমিয়া, ফার্মগেট, বাংলামোটর, মিন্টূ রোড, কাকরাইল (বিচারপতি বাসভবনের মোড়), মৎস্য ভবন, হাইকোর্ট থেকে শাহবাগের দিনে এগোচ্ছে।
ডানেরজন,
–তুই যে টাকা আনছস, সেই টাকা কই? (সে দই এর বক্স হাতিয়ে দেখে এটা আসলেও দই)। কয়টা বাস পোড়াইতে আইছস ঢাকায়। কাল যে অবরোধ জানস না?
-ভাই আমার কাছে কোন টাকা নাই, আমার কাছে যে টাকা সেইটা শুধুই ভাড়ার টাকা। আমি জানিনা কাল যে অবরোধ। আমি ওস্তাদ রে জিগাইছিলাম, কাল অবরোধ আছে কিনা। আপনি উনারে জিগান।
সিএনজি চালক মাথা নেড়ে “হ্যা” বলে!
ততক্ষণে তারা বুঝেছে, তারা ভুল মানুষকে ধরেছে। আমার পকেটে বগুড়া পুলিশ সুপার ও ডিএসবি’র চিঠি তাদেরকে ভিন্ন বার্তা দেয়!
এখন তাদের আচরণে পরিবর্তন আসছে…
ডানেরজন সিএনজি ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
– ওই ব্যাটা, তুই তো ভুল মানুষ উঠাইছস গাড়িতে!
ডান ও বামের দুজন বলছে,
– আপনার কোন জিনিস আমরা নিবোনা। এই উনার সব জিনিস দিয়ে দে।
আমার বাম হাতে দুই মোবাইল, ঘড়ি ধরিয়ে দিলো। ডানেরজন আমার চশমা আর মানিব্যাগ ফিরিয়ে দেয়। তবুও আমি আস্বস্ত হতে পারছিনা, সামনে আবার কোন টুইস্ট আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
ডানেরজন,
– আপনারে এখানে নামাইয়া দিমু। চুপচাপ চলে যাবেন। চিৎকার, চেঁচামেচি করবেন তো ঐখানেই আমাগো লোক আপনার ক্ষতি করবে।
তাদের তিনজন এর কথোপকথন ও র্যুট ডিরেকশন অনুযায়ী বুঝতে পারি, ডানেরজন তাদের লিডার!
টেনিস গ্রাউন্ড এর উইটার্ণে গাড়ি ঘোরায়। শিশু পার্কের বিপরীতে সাইড করিয়ে, বামেরজন আমার দই এর বক্স ধরে ফুটপাতে রেখে এসে আমাকে ধরে নামিয়ে দেয়। আর সিএনজি চলে যায়!
আমি জিনিসপত্র হাত থেকে পকেটে রাখি, ঘড়ি পড়ি আর অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে যাই।
আমি কি সামনে হাটবো না পেছনে হাটবো বুঝতেছিনা। অনেকগুলো সিএনজি ডাকি। শেষমেশ একটা পাই যে চিটাগং রোড যাবে। ভাড়া নিয়ে কথা বলে উঠে বাসায় আসলাম। তবে সেই সময়টুকু মারাত্মক বিষণ্ণতায় কেটেছে। না জানি, সামনে এমন কিছু রিপিট হচ্ছে!!!
নিজের বাসায় যাওয়ার আগে আম্মা-আব্বার সাথে দেখা করি, ঘটনা জানাই বড় ভাইয়া কে সহ। সেখানেই তৈরি হয় আরেক হৃদয় বিদারক মুহুর্তের।
এই ঘটনার বিশ্লেষণে গেলে, আমি বুঝতে পারছিনা যে, এরা আসলে কারা ছিলো?
অপশন A: ছিনতাইকারী!
অপশন B: পুলিশ/ডিবি!
অপশন C: রাজনৈতিক বিশেষ দলের কেউ!
যাইহোক, আল্লাহর অশেষ রহমত আর আব্বা-আম্মার দোয়াতে মারাত্মক বিপদ থেকে মুক্ত হলাম ও একটি কঠিন রাতের সাক্ষী হয়ে গেলাম। এমন ঘটনা কারো জীবনে আসুক, এটা কখনই কাম্য নয়।
দোয়ার দরখাস্ত রইলো।
স্যার, পুরো ঘটনাটা আসলেই শ্বাসরুদ্ধকর ছিলো। আল্লাহ আপনাকে উনার নিজ কুদরতি হাতে বাঁচিয়েছেন। দিন শেষে পরিবারের কাছে ফিরেছেন এটাই আল্লাহর কাছে হাজার কোটি শুকরিয়া।
আলহামদুলিল্লাহ্