পি.এইচ. বড়ুয়া
সাব ইন্সপেক্টর
চাপর থানা, ধুবরি জেলা, আসাম, ভারত
সাইকেল ট্রাভেলার হিসেবে ট্রাভেলিং এর সময় অনেক জায়গায় বিপদে পড়েছিলাম। যা স্থানীয়দের মাধ্যমে রক্ষা পাওয়াটা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের বাহিরে বিপদে পড়লে সেখানে পুলিশ হচ্ছে একমাত্র ভরসা।
গত মাসের মাঝমাঝিতে আমরা দুইজন সাইকেলে বের হই ভারতের তিনটি রাজ্যে সাইক্লিং করা সহ শিলং এর সর্বোচ্চ চুড়ায় উঠবো বলে। পূর্বের প্ল্যান অনুযায়ী প্রথমদিনের রাত্রিযাপন হয় আলিপুরদুয়ার জেলা শহরের মেঘ মালহার হোটেলে। পরের দিন আমরা যথারীতি পশ্চিমবঙ্গ সীমানা অতিক্রম করে আসাম রাজ্যে প্রবেশ করি এবং অনেক পথে এগিয়ে যাই প্ল্যান অনুযায়ী। কিন্তু, ঠিক দুপুরে আমরা নিজদের হেয়ালিপনায় মেতে উঠি রাস্তার পাশের বরই গাছ থেকে বরই খাওয়ার ছলে। বরই খেতে খেতে আমরা হেলে দুলে আগোতে থাকি। চিন্তা তো সেটাই যে মাত্র ১৫৫ কিলোমিটারের টার্গেট আজকের দিনের জন্য। অলরেডি অর্ধেক শেষ, বাকিটা হয়ে যাবে এমন মনোভাবে বরই খেতে খেতে এগোচ্ছিলাম।
এই সময়ে আমাদের মাথায় একবারো আসেনি যে আমরা তো ম্যাপ দেখিনাই অনেক সময় পার হয়ে গেছে। ম্যাপ যখন দেখলাম ততক্ষনে আমরা প্রায় ১১/১২ কিলোমিটার ভুল পথে অর্থাৎ ভুটানের গেলেফু বর্ডারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
ঠিক যেখানটায় আমরা বরই গাছ থেকে বরই পেড়ে খেলাম সেটার ২০০ মিটার আগেই আমরা রাস্তা ফেলে চলে এসেছিলাম।
ব্যাক করা ছাড়া কোন উপায় দেখছিলাম না। একই পথে ব্যাক করে এসে মন টা খুবই খারাপ হয়ে গেলো, আজকের দিনের ২৩/২৪ কিলোমিটার ফাও চালাইলাম। আমাদের মূল টার্গেট থেকে আরো ২৪ কিলোমিটার বেড়ে গেছে। সাথে টেনশন আর ক্ষুধা দুটার চাপেই ছিলাম ভর দুপুরে।
যাক, সেই থেকে খুব স্পীডে টেনে চলে আসি আসামের কোকরাঝাড় জেলা শহরে প্রায় অন্ধকার নেমে আসছে এমন সময়ে। রেল ষ্টেশনে মানুষজন বুদ্ধি দিলো কিভাবে শর্ট রোডে আমরা গোয়ালপাড়া জেলা সহরে পৌছাতে পারি। পথ এখনো বাকি ৫৫ কিলোমিটার।
আসামের অনেক চা বাগান আর উপজাতিদের গ্রাম্য পাহাড়ি আর জঙ্গলের মাঝ দিয়ে অন্ধকারে হেড লাইটের আলোতে এগোতে থাকি শর্টকাট রাস্তায় আশায়। এক সময় আমরা বঙ্গাইগাও জেলার ভুলপুর থানায় ঢুকে পড়ি রাস্তা না পেয়ে। যেটা আমাদের প্ল্যানে ছিলোনা।
সেখানে ভারতীয় আর্মি, পুলিশ চেকপোস্টে আমাদের বিপদের কথা জানাই এবং তারা আমাদের যা বললেন আমরা রীতিমত অবাক।
যে এলাকায় আছি এটা হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা এলাকা। প্রতি মাসে ৩/৪ টা দাঙ্গা সামলোনোর জন্য সব সময় আর্মি, পুলিশ মোতায়ন থাকে এখানে।
আশেপাশে ২৫/৩০ কিলোমিটারের মধ্যে কোন হোটেল আছে এমন শহর বা এলাকা নেই। যেটা করতে পারেন, আপনারা ধুবরি জেলার চাপর থানাইয় যেতে পারেন। যেখানে সরকারী বাংলো আছে। তবে আগে পুলিশের সাথে আপনাদেরকে দেখা করতে হবে।
এই পর্যন্ত এসে গেলাম প্রায় ১৩২ কিলোমিটার। চাপরের বাকি ৭ কিলোমিটার। রাত তখন ৮ টা। অথচ আমাদের পূর্বের প্ল্যানের(গোয়ালপাড়া জেলা শহর) থেকে আমরা এখনো ৪০ কিলোমিটার পিছিয়ে আছি। পরের দিনের টার্গেট আরো ৪০ কিলোমিটার বেড়ে গেছে। যা আমরা পরের দিন পূরন করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
হাইওয়ে তে এগোতে থাকলাম। প্রায় ৫০ কিলোমিটার পরে হাইওয়ে পেলাম আমরা। এবার ভয় টা কম লাগছে।
চাপর থানায় আসা মাত্র পুলিশ আমাদের পরিচয় জানতে চায়। হেলমেটের উপরে, জার্সির এক পাশে এবং ব্যাগের পেছনে বাংলাদেশের পতাকা দেখে বললেন, (বিলিভ ইট অর নট) হাত দিয়ে রাস্তা দেখিয়ে সম্মানের সাথে আইয়ে জনাব, আইয়ে। আন্দার ম্যা আইয়ে। হামারে এস আই সাব অফিস কি আন্দার হ্যায়।
যদিও আমি হিন্দি ভালো বুঝিনা। কিন্তু এমনটাই আরো সুন্দরভাবে বলেছেন তা শিউর।
আমি আহসান ভাইকে বাহিরে সাইকেল সহ রেখে ভেতরে যাই।
সেই পুলিশ চেয়ার টেনে দিলে একজন অফিসার আমার সাথে হ্যান্ড শেক করে চেয়ারে বসার জন্য বললেন। ইনিই সেই পি.এইচ. বড়ুয়া। জন্মসূত্রে উনি নাগাল্যান্ড এর।
জানালাম বিস্তারিত, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তিনি শুনেই এতোই খুশি হলেন যে, চিৎকার দিয়ে জানালেন, চায়ে লে কার আও। হামারে মেহমান আয়া। তখন সেখানে প্রচণ্ড ঠান্ডা পরছিলো।
নিজের কাছে কেমন অনুভূতি কাজ করছে বুঝাতে পারবোনা।
আমাদের পাসপোর্ট, ভিসার, ইমিগ্রেশন এর পাতা কপি করে নিলেন এবং খাতায় এন্ট্রি করলেন আমাদের সিগনেচার সহ।
তিনি আমাকে দুঃখের সাথে জানালেন, আপনাদের আসার ৫ মিনিট আগেই ত্রিপুরা থেকে ৪০ জন পুলিশ আসছে যারা ধুবরি যাচ্ছে ট্রিনিং এ। এখানেই আজকে রাত্রি যাপন করবেন। তারাই একটিমাত্র বাংলো সেটাই দখল করে নিয়েছেন। আর এখানে কোন হোটেল ও নেই আশেপাশে।
উপায়ন্তর না পেয়ে স্থানীয় এলজিপি নেতাকে ডেকে আনলেন। একজন নেতা+ব্যবসায়ী আসলেন আমাদের অতিথি হিসেবে নেওয়ার জন্য। তিনিও মুসলিম ছিলেন। আমাদের সেদিনের থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন সেই নেতা উনার এক ভাতিজার বাসায়।
এবং মি; বড়ুয়া সাহেব গুয়াহাটি পর্যন্ত মেসেজ পৌঁছে দিলেন যে দুইজন বাংলাদেশি আগামীকাল এই রাস্তা দিয়ে গুয়াহাটি যাবেন সাইকেলে। যেকোন প্রয়োজনে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিবেন আশা করি। তিনি আমাদের পাসপোর্ট, ভিসার কপি গোয়ালপাড়া এবং কামরুখ জেলার কয়েকটি থানায় ইমেইল করে পাঠিয়ে দিলেন রাতেই।
সেদিন আমরা খুবই ভালো ভাবে রাতের খাবার খেয়ে, ঘুমিয়ে পরদিন ভোরে গুয়াহাটির দিকে রওনা হই।
লেখার ভাষায় একজন ভারতীয় পুলিশ অফিসারের উপকারের কথা হয়তো বুঝাতে পারিনি। কিন্তু আমি সামনা-সামনি দেখেছিলাম উনার আন্তরিকতা। কোন দিন ভুলবোনা উনার উপকারের কথা। ফিরে এসে ইমোতে মেসেজ দিয়েছি আমরা ঠিকমত পৌঁছেছি। ধন্যবাদ দিয়েছিলাম আসার পরেও। কিন্তু তিনি আমাদের সাহায্য করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছেন বলে জানান।
ভালো থাকুন স্যার। স্যালুট ফ্রম এ বাংলাদেশি সাইক্লিষ্ট এন্ড ট্রাভেলার।